বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে প্রচলিত ভুল ধারণাঃ

বর্তমান সময়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। কিন্তু কেনো সে বিদেশে পড়তে যেতে ইচ্ছুক সে বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য জানা নেই। সঠিক তথ্য অনুযায়ী অনেক শিক্ষার্থী তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলেও অনেকে সঠিক তথ্য ও জানাশোনার অভাবে মাঝপথে এসে সব হারিয়ে তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। তাই বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনার স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। তবে সঠিক তথ্য না জানা থাকলে বিভ্রান্তির বেড়াজালে পড়ে অনেকের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আবার কারও কারও ভুল তথ্য নির্ভর আঁকা স্বপ্নের সাথে বাস্তবের চরম অমিলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। বিভ্রান্তিকর তথ্যের উপর এই স্বপ্নের যাএা অনেকের ক্ষেত্রেই সুখকর হয় না।আজকে আমরা এই বিষয় নিয়েই কিছু কথা বলব।

ইংরেজি দক্ষতাঃ

 আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগেরই পছন্দের দেশ যুক্তরাজ্য,যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,অস্ট্রেলিয়া,জার্মান,জাপান সহ উন্নত দেশগুলোতে। এসব দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ভাষা দক্ষতার সনদ অন্যতম শর্ত (i.e. IELTS/PTE)। তবে ভালো স্কোর থাকলে বৃওি পাওয়া যায়, ভিসা নিশ্চিত, ভর্তি সহজ হয় এমন অনেক ধারণা আমাদের মাঝে আছে। বাস্তবে তা নয়, ভাষা দক্ষতা শুধুমাত্র ভর্তির একটা যোগ্যতা। দেশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেদে এর তারতম্য রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোর্সের ভর্তি আবেদনের যোগ্যতা অনুযায়ী এই স্কোর 5.5 থেকে 7.5 পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং,ভাষাগত দক্ষতা একটি শর্ত হতে পারে, তবে এটি আপনার ভর্তি বা বৃত্তির নিশ্চয়তার সহায়ক না।

পূর্ববর্তী শিক্ষাগত যোগ্যতা:

 আমাদের মাঝে ধারণা রয়েছে যে, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিতে চাইলে আমাদের পূর্ববর্তী একাডেমিক ফলাফল অনেক ভালো হতে হয়। অর্থ্যাৎ আমাদের GPA/CGPA অনেক ভালো না হলে, দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখা ঠিক হয়, বাস্তবিক পক্ষে তা কিন্তু নয়। উন্নত দেশসমূহে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির যোগ্যতা পূর্ববর্তী একাডেমিক পরীক্ষার শতকরা ৬০-৭০ ভাগ নম্বর অর্জন করতে পারলে হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্ধারিত কোর্সের ওপর নির্ভর করে রেজাল্ট কেমন হতে হবে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্র (যেমনঃ সহশিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণা বা কাজের অভিজ্ঞতা) উপস্থাপন করে রেজাল্ট কম হলেও আবেদন করা যায়। তবে একাডেমিক ফলাফল ভালো বৃত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

আর্থিক সক্ষমতাঃ

 বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে খরচের বিষয়টা। আমরা মনে করি বিদেশে পড়াশোনা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন।নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য বিদেশে পড়ার স্বপ্ন কেবল একটা আকাশ কুসুম কল্পনা। আবার একদল মানুষ মনে করে দেশের বাইরে ফুল স্কলারশিপ পেয়ে একেবারেই ফ্রী পড়াশোনা করা যায়। এরকম কিছু মিথ আমাদের দেশে লক্ষ্য করা যায়। অথচ সত্য হলো আপনার টিউশন ফি এর পুরো ফান্ড না থাকলে সেক্ষেত্রে আপনাকে পার্ট টাইম কাজ করে তা পরিশোধ করতে হবে। আবার আপনার পূর্ববর্তী একাডেমিক ফলাফল ও অন্যান্য যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে স্কলারশিপ পেতে পারেন। অন্যদিকে আপনার টাকা থাকলেই পড়তে পারবেন এমনটা নয়। মেধা ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। নতুবা ভর্তি হতে পারলেও আপনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হবেন।

পড়াশুনার চাপঃ

 বিদেশে পড়াশোনার জন্য দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই গভীরভাবে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারন প্রতিটি দেশে পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা এক রকম নয়। যেমন- কোন দেশে টিউশন ফি বেশি, কোন দেশে কম, আবার টিউশন ফি আদৌ লাগেনা আবার কোন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই মানের কোর্সের মেয়াদ কম, কোন দেশে আবার বেশি। কোথাও পার্ট টাইম জব করা যায়, কোথও পার্ট টাইম জব হয়তো পাওয়া যায় না, আবার কোথাও কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। কোন দেশে সহজেই স্কলারশিপ পাওয়া যায়, আবার কোন কোন দেশে স্কলারশিপ পাওয়া বেশ কঠিন। কোন দেশের আবহাওয়া খুবই বিরূপ, আবার কোন দেশের আবহাওয়া নান্দনিক ও স্বাস্থকর। আবার এমনও দেশ আছে যেখানে পড়াশোনাকালীন সময়েই নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা থকে। আবার আমাদের দেশে মনে করে হয় বিদেশের পড়াশোনা বেশ দুর্বোধ্য ও যথেষ্ট চাপের বিষয়। অন্যমতে, বাইরে পড়াশোনা করতে তেমন কষ্ট করতে হয় না। বেশ আরাম আয়েশে পড়াশোনা শেষ করা যায়। দুটো ধারনাই হল প্রচলিত বিভ্রান্তি। আসলে বিদেশে পড়াশোনা খুব বেশি দুর্বোধ্য তা নয়। তবে পড়াশোনা ঠিকমতো না করে কেবল মজা-মাস্তি করে স্টাডি শেষ করা যায় এমনটাও ঠিক না। বিদেশে পড়ে এমন অনেক বন্ধুদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবি দেখে এমনটা মনে হতে পারে। তবে বাস্তবিক পক্ষে যথেষ্ট পরিশ্রমী হতে হয়।

অর্থ উপার্জনঃ

 দেশ ছেড়ে যেতে পারলে লাইফ স্যাটেল, এমন ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এটাও একটি ভুল ধারণা। আমরা মনে করে থাকি বিদেশ যেতে পারলেই প্রচুর টাকা উপার্জন করা যায়, ভালো ভালো চাকরি পাওয়া যায়। আবার অনেকে মনে করেন বিদেশের একটা ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরলেই ভালো বেতনের কাল চাকরি নিশ্চিত। মূলত আপনি যেখানেই থাকেন না কেন বা চাকরি করেন না কেন, আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা ও পরিশ্রমের সক্ষমতা অনুযায়ী আপনার জীবন প্রতিষ্ঠিত হবে। মনে রাখতে হবে যেখানে অর্থ উপার্জনের সুযোগ বেশি, সেখানে জীবনযাপনের খরচও বেশি। তাই পেশাগত উন্নতি ও লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য কোন ধরনের পেশা আপনার জন্য উপযুক্ত তা খুঁজে বের করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি পেশাগত সফলতা বা আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সেই পেশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্সে উচ্চশিক্ষা গ্রহন কম তাৎপর্যপূর্ন নয়। তাই বর্তমান গ্লোবালাইজেশনের যুগে উচ্চশিক্ষার অনেক কোর্সের মধ্যে আপনাকে এমন একটী কোর্স বেছে নিতে হবে যা আপনার ভবিষ্যৎ পেশাগত দক্ষতার পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে গণ্য হবে।

সর্বোপরি, জীবনটা পুষ্পের বিছানা নয়। বরং, দীর্ঘ সংগ্রামের যাএা। আপনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেন, আপনাকে এ যাএায় পরিশ্রমী ও সংগ্রামী হতে হবে। বিদেশে যাওয়ার অনেকগুলো কারন থাকতে পারে, তবে তা যেন সার্থক ও ইতিবাচক হয়। মনে রাখবেন, একটি ভিন্ন দেশের ভিন্ন পরিমন্ডলে জীবন যাপন এবং শিক্ষা গ্রহনের সাথে মানিয়ে নেয়া কঠিন ও শ্রমসাধ্য। তবে পরিশ্রমের দৃঢ় মানসিকতা ও একনিষ্ঠ মনবল থাকলে জীবন কে উপভগ করা যায়।

Share

Add Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *